শনিবার ৮ নভেম্বর ২০২৫ - ২১:৩৫
ট্রমা জীবনে কী প্রভাব ফেলে?— কর্মশালায় বিশেষজ্ঞের বিশদ ব্যাখ্যা

মাদ্রাসায়ে রাইহানাতুর রাসূল (সা.)-এ “ট্রমা থেকে মুক্তির যাত্রা” শীর্ষক বিশেষায়িত কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। কর্মশালায় বক্তৃতা করেন হাওজায়ে ইলমিয়া ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. নিলুফার সাদরি। তিনি ট্রমার সংজ্ঞা, ধরন এবং এর গভীর ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বিশেষ করে “জটিল ট্রমা” নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: ড. সাদরি বলেন, ট্রমা হলো এমন একটি বা একাধিক অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও সহনক্ষমতার বাইরে থাকা অভিজ্ঞতা, যা ব্যক্তি স্বাভাবিকভাবে সামাল দিতে পারে না। ঘটনা যখন এতটাই কঠিন হয় যে মন ও শরীর তা স্বাভাবিকভাবে প্রক্রিয়া করতে পারে না, তখন সেই অভিজ্ঞতার স্থায়ী প্রভাবই ট্রমা তৈরি করে।

জটিল ট্রমা: সবচেয়ে গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী ট্রমা
কর্মশালার বড় একটি অংশ জুড়েই ছিল “জটিল ট্রমা” পরিচিতি ও বিশ্লেষণ। ড. সাদরি বলেন, জটিল ট্রমা এমন সম্পর্কের ভেতরেই গড়ে ওঠে, যেগুলো মূলত নিরাপদ হওয়ার কথা— যেমন পরিবার, অভিভাবক, বা আবেগিক সঙ্গী।

সহজ ভাষায় তিনি ব্যাখ্যা করেন, যখন একটি শিশু দীর্ঘ সময় ধরে এমন পরিবেশে বড় হয় যেখানে নিরাপত্তার বদলে ভয়, অবহেলা, অপমান বা আবেগিক অস্থিরতা থাকে, তখন তার মধ্যে গভীরভাবে স্থায়ী জটিল ট্রমা তৈরি হতে থাকে। ফলে সে শেখে যে দুনিয়া নিরাপদ জায়গা নয় এবং সে ভালোবাসার যোগ্য নয়।

জটিল ট্রমার বৈশিষ্ট্য ও উদাহরণ
সাধারণ এককালীন ট্রমা— যেমন দুর্ঘটনা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ—এর তুলনায় জটিল ট্রমা অনেক গভীর কারণ এটি:
• পুনরাবৃত্ত ও দীর্ঘস্থায়ী
• ব্যক্তি–ব্যক্তি সম্পর্ক থেকে উদ্ভূত
• শিশুকালের বিকাশ-পর্যায়ে ঘটে
•মস্তিষ্ক ও ব্যক্তিত্ব গঠনে সরাসরি প্রভাব ফেলে

তিনি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন:
• শরীরিক বা যৌন নির্যাতনের পুনরাবৃত্ত অভিজ্ঞতা
• দীর্ঘস্থায়ী আবেগিক অবহেলা
• নিয়মিত অপমান, হুমকি বা লজ্জা দেওয়া
• মাদকাসক্ত বা অত্যন্ত রাগী বা মানসিকভাবে অস্থির বাবা-মায়ের সঙ্গে বড় হওয়া
• ঘন ঘন পারিবারিক সহিংসতা প্রত্যক্ষ করা

প্রাপ্তবয়স্ক বয়সে যেসব সমস্যায় ভুগতে দেখা যায়
জটিল ট্রমার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রাপ্তবয়স্করা সাধারণত নিম্নলিখিত চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হন:
• অন্যদের বিশ্বাস করতে সমস্যা
• সামান্য প্রত্যাখ্যানেও অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা
• আঘাতের ভয়ে ঘনিষ্ঠতা চাওয়া ও সম্পর্ক এড়িয়ে যাওয়ার মধ্যে দোলাচল
• আত্মসম্মানবোধ কমে যাওয়া
• আবেগ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা— যেমন হঠাৎ রাগ, আবার কখনো সম্পূর্ণ অনুভূতিহীনতা
• শারীরিক উপসর্গ— যেসব ব্যথার পেছনে স্পষ্ট চিকিৎসাগত কারণ থাকে না

ট্রমার শারীরবৃত্তীয় প্রভাব
ড. সাদরি ব্যাখ্যা করেন যে ট্রমা মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রকে কীভাবে প্রভাবিত করে। দীর্ঘমেয়াদি ট্রমা স্নায়ুতন্ত্রকে “লড়াই, পালানো অথবা স্থবির হয়ে যাওয়া” অবস্থায় আটকে রাখতে পারে। এতে স্ট্রেস হরমোন কর্টিজল অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে। মস্তিষ্কের ভয়ের কেন্দ্র (অ্যামিগডালা) অতিসক্রিয় হয়ে ওঠে এবং যুক্তিবোধ নিয়ন্ত্রণকারী প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স দুর্বল হয়ে যায়।

সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা ও করণীয়
কর্মশালার শেষে তিনি জোর দিয়ে বলেন, ট্রমা যত গভীরই হোক, সঠিক সহায়তা ও প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সুস্থতা সম্ভব। তিনি যে কয়েকটি উপায় সুপারিশ করেন:
• ট্রমা এবং সাধারণ মানসিক চাপের পার্থক্য বোঝা
• ট্রমা কীভাবে শরীরে সঞ্চিত হয় তা বোঝা
• স্নায়ুতন্ত্র শান্ত করার সহজ অনুশীলন
• ধ্যান ও মাইন্ডফুলনেস চর্চা
• পেশাদার মনোচিকিৎসা গ্রহণ করা

সক্রিয় প্রশ্নোত্তর পর্বের মাধ্যমে কর্মশালার সমাপ্তি ঘটে। আয়োজকদের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে ভবিষ্যতে এই বিষয়ে আরও উন্নত পর্যায়ের কোর্স আয়োজন করা হবে।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha